Rose Good Luck ভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-১৭) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৩ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:২০:৫৭ রাত



Good Luck দুপুরবেলাটা অফিসে শাহেদের তেমন একটা ভালো যায় না। যদিও সে লাঞ্চ নিয়ে আসে। কিন্তু লাঞ্চ আওয়ারে কখনো সঠিক সময়ে সে খেতে বসতে পারে না। একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত লাঞ্চটাইম। কিন্তু এই সময় অন্যদের জন্য।

আজও জোহরের নামাজ শেষ করে কেবল নিজের চেম্বারে খেতে বসবে, এমন সময় ডিরেক্টর স্যারের ফোন। ধোয়া হাত আবার মুছে স্যারের রুমের দিকে আগায়। পেটের ক্ষুধার অনুভূতি কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে ওয়েটিং লিস্টে অবস্থান নেয়। শাহেদের ফ্যাক্টরীর মালিকের ছেলে নতুন ডিরেক্টর হয়ে এসেছেন। ইংল্যাণ্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের উপর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। দু'মাস হল অফিস করছেন নিয়মিত। শাহেদের কাছে খারাপ লাগে না এই নতুন স্যারকে। তবে মানুষের আসল রুপ এতো সহজে ধরা পড়ে না। তাই কারো সম্পর্কে এতো দ্রুত কোনো ধারনা করাটাও ঠিক না।

ডিরেক্টর স্যারের রুম থেকে কাজ শেষে যখন বের হল, পৌনে দু'টা বেজে গেছে। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। এভাবেই ইদানিং বেশ অনিয়ম হচ্ছে। বিথীকে জানায় না অবশ্য। খাবারগুলো শাহেদের পিওনের পেটে চলে যায়। ফ্যাক্টরীর সামনের একটি বেকারীর কিছু ভালো বিস্কিট রাখা আছে। সেগুলো দিয়ে লাঞ্চের ক্ষুধা মিটায় শাহেদ।

তবে সে আশ্চর্য হয়ে ভাবে, ইদানিং এমন অনিয়মের ফলে ওর চেহারার পরিবর্তন বিথীর নজরে আসে না। তবে এতোদিন পর ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলে মায়ের চোখে ঠিকই পড়ে। চোখ দুটো কেন ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, গালের হাড় বের হয়েছে কিভাবে কিংবা কলার বোনের হাড় দুটো এভাবে বের হয়ে আছে কেন ইত্যকার প্রশ্ন কি শুধু মায়ের থেকে দূরে থাকায় স্নেহের অতিরিক্ত নির্যাস হয়ে উছলে পড়ে? আসলেই কি তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে? চেম্বার লাগোয়া বাথরুমের বেসিনের উপরের আয়নায় নিজেকে দেখে শাহেদ। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। চোখের নিচেও একটু কালি পড়েছে।

বিথী কেন মায়ের মত এগুলো লক্ষ্য করল না?

সে কি ধীরে ধীরে এতো কাছে থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে?

নিজের চেম্বারের রিভলবিং সীটে বসে শাহেদ। এলোমেলো কত কিছু ভাবনা বয়ে যেতে চায় এ হৃদয়ে। সব ভাবনাগুলোরও এই সময়ে কেন আসতে হবে? বেল টিপে পিওনকে ডাকে। সে এলে লাল চা করে আনতে বলে। সাথে বিস্কিট।

পিওন খুব খুশী মনে রুম থেকে বের হয়। আজকেও স্যারের বাসার লোভনীয় খাবারগুলো সে খেতে পারবে।

পিওন ছেলেটি আসতে আসতে নেট থেকে একটু ঘুরে আসে। আজকাল কয়েকটি বাংলা ব্লগে কিছু প্রিয় লেখকদের লিখা পড়ার নেশা হয়েছে। আর ফেসবুক তো মহামারির মত লেগেই আছে।

পিওন শাহেদের জন্য চা আর বিস্কিট রেখে গেলো। ব্লগে একটা লিখা অর্ধেক পড়ে রেখে দিয়েছিল। চা-বিস্কিট খেতে খেতে বাকীটুকু শেষ করল।

এক বিবাহিত যুবকের গল্প। যে নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি শুনে মা-বাবাকে যেন সবসময় নিজের কাছে কাছে রাখতে পারে, সেই মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তবে বিয়ের পর কিভাবে যেন সেই উৎসাহে ভাটা পড়ে। বউ আর বৃদ্ধা মায়ের ভিতরে চলে আসা দুই প্রজন্ম-ব্যবধানের চিরায়ত দ্বন্দ্ব এবং ছোটখাটো আশাগুলোর মরে যাওয়াতে একে অপরকে দোষারোপ করার প্রবণতা যুবকের সেই আশা ভেঙ্গে যায়। তবে সে বাবা-মাকে দূরে রেখে তাদের প্রতি ছেলে হিসাবে যা যা করণীয়, সব করার প্রতিজ্ঞা করে। গ্রামের বাড়িতে বাবা মাকে রেখে আসে। প্রতি মাসে একবার করে তাদের সাথে সময় কাটিয়ে আসে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়। প্রতিদিন মোবাইলে কথা বলে। কিন্তু বাবা-মায়ের মন কি তাতে ভরে? ছেলের সান্নিধ্য-ই তাদের একমাত্র চাওয়া। মাস ব্যাপী তারা ছেলের প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকে। হৃদয়ের সকল ভালোবাসা ছানি পড়া দৃষ্টি ছাপিয়ে দূরে... বহুদূরে ব্যপৃত হয়। কিন্তু ছেলে এই পৃথিবীতে ওর জন্য যে দুজন মানুষের এই নীরব-গোপন ভালোবাসা, তা টের পায় না। সে মনে করে বাবা মায়ের জন্য সে যা করছে, এটাতেই ওনারা বড্ড সুখে আছেন। আর ওর কাছে থাকার সময়গুলোতে বাবা মা যে সুখের অভিনয় করেন, তাতে ছেলের ধারনা আরো বদ্ধমূল হয়।

একদিন ছেলে গ্রামের বাড়িতে বাবা মায়ের একান্ত কিছু কথা শুনে ফেলে। ওর চিন্তার জগতটি ভেঙ্গে যায়। নিজের স্বপ্নকে ছিন্ন ভিন্ন অবস্থায় নিজের সামনে দেখতে পায়। মায়ের চোখের জল আর বাবার বুক ফাটা কষ্টগুলো দীর্ঘশ্বাসের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে ওর অনুভবে নির্মম সত্যকে জানান দেয়। সে সন্তান হয়ে এতদিন এ কি করেছে? নিজের সত্তাকে দূরে রেখে কেবল খোলস সর্বস্ব নিজেকে নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছে!

ওর সকল অনুভূতি গলে গলে বরফ হয়ে গেল যখন ওর বৃদ্ধা মা ওকে বলল,

: বাবা, তুই আমাদের এতো দূরে না রেখে, তোর কাছাকাছি কোনো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আস। তবুও তো মন চাইলেই তোকে যখন তখন দেখতে পারব।

ছেলে এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে?

এখানেই গল্পটি শেষ হয়ে গেছে।

শাহেদ গল্পটি পড়ে ঐ যুবকের মত কষ্টে নীল হতে থাকে। গল্পের যুবকটির সাথে ওরও অনেক মিল রয়েছে চিন্তা-ভাবনা আর কর্মকান্ডে। সেও তো এই বৃদ্ধাশ্রম গানটি শুনে অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছিল। আর নিজের বড় ভাই রায়হানের সাথে বাবার অপ্রত্যাশিত দূরত্বের ফলে বাবা মায়ের মলিন মুখ এবং ভগ্ন হৃদয়ের কথা চিন্তা করে বাবার পছন্দের মেয়েকে এক কথায় বিয়ে করেছিল। একটা দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, মা বাবাকে কখনো নিজের থেকে দূরে রাখবে না। কিন্তু ওর জীবনেও সেই একই ভুল দেখা দেয়।

ভুল?

নাকি নিজের স্বেচ্ছায় নির্লীপ্ত হয়ে থাকা?

শাহেদ একটু শক্ত হলে আজ বাবা মাকে গ্রামে পড়ে থাকতে হয় না। বিথীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, ধীরে ধীরে জনক জননীর হাসি মুখ ওর থেকে বিস্মৃত হয়। অবশ্য রাশেদুল করীম সাহেবও একটা পর্যায়ে নিজেদেরকে ছেলের পরিবার থেকে দূরে রাখতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত যে একটা অভিমানের উপর ভিত্তি করে হয়েছে, সেটা বুঝেও শাহেদও কি একটুও জোর করেছিল বাবা মাকে কাছে রাখার জণ্য?

একটুও কি মানাতে গিয়েছিল? কিংবা জেদ ধরে ছিল?

নাহ!

সে কিছুই করে নাই। নিজের শহুরে জীবনে নিরবচ্ছিন্ন এক শান্তি খুজে পেতে সে গল্পের যুবকটির মত মানসিকতা নিয়ে নিজের চিন্তা-ভাবনার গন্ডীতে আবদ্ধ হয়ে ছিল। আজ এই গল্পটি ওকে যেন ওর মোহাবিষ্ট অবস্থা থেকে ওকে বের করে নিয়ে এলো। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে কি সবাইকে এক সাথে রাখার জন্য সেরকম এক পরিবেশ তৈরী করার মত যথেষ্ট শক্ত হতে পারবে?

এক দিকে বিথী এবং অন্তর... অন্য দিকে মফস্বল শহরে একাকী জীবন কাটানো বাবা মা। দুই প্রজন্মের ব্যবধান আর কিছু বৈরী মনোভাবকে এক করে একই সমান্তরালে নিয়ে আসার মত দুরূহ কাজটি করতে হবে শাহেদকে।

হয়ত ওকে এই কাজটি করতে গিয়ে কিছু একটা হারাতে হবে... কিছু মনোমালিন্য... কিছু ভালোলাগার অপমৃত্যু... এরকম অনেক কিছু সামনে আসবে। সে পারবে কি এগুলোকে অতিক্রম করতে?

নিজের চেম্বারে বসে বসে একজন সহকারী জেনারেল ম্যানেজারের কানে এক বৃদ্ধা মায়ের করুণ আকুতি গল্পের পাতার ভিতর থেকে বের হয়ে বাজতে থাকে... ‘বাবা, তুই আমাদের এতো দূরে না রেখে, তোর কাছাকাছি কোনো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আস...’

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

৯৮০ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

280929
০৩ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:৩৭
আফরা লিখেছেন : আসলেই ছেলেরা অনেক ভাল ।সংসারে একটু শান্তির জন্য তারা অনেক ছাড় দেয় নিজের বাবা মাকেও কাছে রাখতে পারে না যদিও মানষিক কষ্ট পায় সেটা ও লুকিয়ে রাখে ।তার পর কি শান্তি পায় ।

০৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:১১
224559
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ।
নাহ, শান্তি নিজের কাছের মানুষদেরকে দূরে রেখে আসতে পারে না। সাময়িক স্বস্তি আসসে হয়ত, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন মনের শান্তি পাওয়া যায় না।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।Good Luck
280935
০৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:০৩
০৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:১২
224560
মামুন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
280966
০৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০২:২০
সন্ধাতারা লিখেছেন : Chalam vaiya. Jajakallahu khair for ur beautiful writing.
০৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৫১
224613
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম আপু। অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।Good Luck
280974
০৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৩:৫৪
কাহাফ লিখেছেন :


"স্বার্থবিহীন এতো ভালবাসা-
দেবে কে মায়ের মতন!
স্বার্থের আঘাতেই সব কিছু-
ভাংগে তবুও,মা-ই তো আপন!!"
লেখনীর প্রতি টা শব্দে যেন চির সত্য এমন অনুভূতিই মিশে রয়েছে।
মাতা-পিতার'হক্ব'যেন যথাযথ আদায় করতে পারি আমরা সন্তানেরা- করুণাময় আল্লাহর কাছে এই তৌফিক কামনা করছি।
শাহেদদের জন্যেও অনেক শুভ কামনা!!
Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up Rose Rose Rose
০৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৫২
224614
মামুন লিখেছেন : সুন্দর অনুভুতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
আপনার দোয়ায় আমীন।Good Luck Good Luck
280997
০৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৫:২২
কাঁচের বালি লিখেছেন : আমার মা , আপনার মা , সবার মা , সে তো "মা "
মা শুধু মা-----ই ।
খুব সুন্দর লেখা ভালো লেগেছে ।
০৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৫৩
224615
মামুন লিখেছেন : আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম!
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।Good Luck
281004
০৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৬:২৩
রাইয়ান লিখেছেন : আজকের স্বাধীনচেতা তরুনীরা যৌথ পরিবারে একসাথে থাকাটা তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও ভালোলাগার অন্তরায় মনে করে , আর তার ফল ভোগ করে তার বেচারা স্বামী আর অসহায় শ্বশুর শ্বাশুড়ি। মেয়েদের কষ্টগুলো সবাই অনুভব করতে পারে , কিন্তু আজকাল বিয়ের পরে পুরুষরাও যে কত রকম মানসিক অশান্তির ভেতর দিয়ে যায়, কে ই বা তার খোঁজ রাখে !
০৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৩৯
224596
কাহাফ লিখেছেন :
নির্মম সত্য আপনার কথাগুলোর সাথে একমত না হয়ে পারছিই না!!!Praying Praying Praying
০৪ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৫৬
224616
মামুন লিখেছেন : সুন্দর ভাবে কিছু বাস্তব কথাকে তুলে ধরলেন, অনেক ধন্যবাদ। সহমত আপনার সাথে।Good Luck Good Luck
281101
০৪ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৪২
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : কিছু বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ। Thumbs Up Rose Rose Rose
০৪ নভেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৮
224739
মামুন লিখেছেন : অনুভুতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।Good Luck
281276
০৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:০৩
তোমার হৃদয় জুড়ে আমি লিখেছেন : পড়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম তাই কিছু লিখতে পারলাম না। Sad

সুন্দর লেখাটির জন্য Rose Rose Rose
০৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:১২
224888
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
শুভকামনা রইলো।Good Luck
281348
০৫ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:১৩
নাছির আলী লিখেছেন : মা শুধু মা এর তুলনা কো শব্দ নাই। তুলনাহিন ভালবাসা
আর মায়াবি দয্টি মা ছাড়া আর কে দেবে ? আমি যেন মার
সেবা করতে পারি এই কামনা করি আল্লার কাছে | আপনার এই অতুলনিয়
লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ |
০৫ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:০১
224961
মামুন লিখেছেন : আপনার ইচ্ছেটা যেন পুরণ করেন মহান আল্লাহপাক-আমীন।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ ভাই।Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File